
দেশের প্রধান লবণ উৎপাদন কেন্দ্র কক্সবাজারে মৌসুমের শুরুতেই মাঠ পর্যায়ে লবণের দাম অস্বাভাবিকভাবে কমে গেছে। এর পেছনে রয়েছে বহুবিধ কারণ। গত মৌসুমের চেয়ে এবার মণপ্রতি দাম কমেছে কমপক্ষে ১০০ টাকা। যেখানে গেল মৌসুমে মণপ্রতি লবণ বিক্রি হয়েছে ৪০০ টাকা, সেখানে এবারের উৎপাদিত লবণ বিক্রি হচ্ছে সর্বোচ্চ মণে ৩০০ টাকা দরে।
অথচ চাষিদের মতে, উৎপাদন খরচই পড়ছে মণপ্রতি ৩৫০ টাকার বেশি। এ কারণে উপকূলের লবণ মাঠের উৎপাদনে এবার শ্লথগতি দেখা যাচ্ছে। বিসিকের তথ্য মতে, গত বছর শেষ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে লবণ উৎপাদন করা হয়েছিল ৪৯ হাজার মেট্রিক টন। আর এবার একই সময়ে উৎপাদন কমে দাঁড়িয়েছে ২৬ হাজার ৬৭৪ মেট্রিক টন।
উৎপাদন খরচের চেয়ে বিক্রিমূল্য কমায় হতাশ হয়ে পড়েছেন চাষিরা।
লবণ চাষিদের নিয়ে হবে উদ্বুদ্ধকরণ সভা :
বিসিকের কক্সবাজার জেলার লবণশিল্পের উন্নয়ন কার্যালয়ের উপপরিচালক জাফর ইকবাল ভুঁইয়া লবণের দাম কমার কথা স্বীকার করেন। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘শুরুর প্রায় মাস দেড়েক সময় অতিবাহিত হলেও এখন পর্যন্ত ৭০ শতাংশ চাষি মাঠে নেমেছেন। বাকি ৩০ শতাংশ চাষি মাঠেই নামেননি।
ফলে লবণ উৎপাদনে গতিও ফিরছে না।’
তিনি বলেন, লবণ চাষিদের হতাশা কাটিয়ে উৎপাদনে উৎসাহিত করতে চলতি মাসেই লবণ চাষিদের জন্য উদ্বুদ্ধকরণ সভার আয়োজন করা হবে। এতে শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও উপস্থিত থাকবেন।
লবণ উৎপাদন হয় ৬৫ হাজার একর জমিতে :
কক্সবাজার উপকূলের লবণ উৎপাদনের ৬২ বছরের ইতিহাসে গেল মৌসুমে রেকর্ড পরিমাণ ২৪ লাখ ৩৮ হাজার মেট্রিক টন লবণ উৎপাদিত হয়েছিল। এর মধ্যে উৎপাদিত চার লাখ মেট্রিক টন লবণ মজুদ ছিল চাষিদের কাছে।
বিসিক এবার অপরিশোধিত লবণ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে ২৬ লাখ ১০ হাজার মেট্রিক টন। দেশে চাহিদাও রয়েছে প্রায় ২৫ লাখ মেট্রিক টন। কক্সবাজারের মহেশখালী, কুতুবদিয়া, পেকুয়া, চকরিয়া, কক্সবাজার সদর, ঈদগাও ও টেকনাফ উপজেলা এবং চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার অন্তত ৬৫ হাজার একর জমিতে লবণ উৎপাদন করা হয়ে থাকে। চাষির সংখ্যা প্রায় ৬৫ হাজার।
হাজার হাজার মণ লবণ অবিক্রীত :
গত বছর লবণ উৎপাদনে চাষিরা ভালো টাকা পাওয়ায় মাঠের লাগিয়ত এবার ২০ গুণেরও বেশি বেড়েছে। শ্রমিকের পারিশ্রমিকসহ অন্যান্য খরচও বেড়েছে, কিন্তু সেই তুলনায় উল্টো লবণের দাম কমেছে। এতে বিপাকে পড়েছেন চাষিরা। মহেশখালী উপজেলার কালারমার ছড়ার উত্তর নলবিলার এলাকার লবণ চাষি জামাল উদ্দিন (৪০) বলেন, ‘প্রতি কানি (৪০ শতক) ৩৫ হাজার টাকা করে ছয় কানি জমি নিয়ে লবণ উৎপাদনে মাঠে নামি।
পলিথিন, শ্রমিকের মজুরি, লবণ উৎপাদনের বিভিন্ন উপকরণসহ প্রতি মণ লবণ উৎপাদনে খরচ হয় ৩৫০ থেকে ৩৭০ টাকা। কিন্তু মৌসুমের শুরুতে প্রতি মণ লবণ বিক্রি হচ্ছে ২৬০ থেকে ৩০০ টাকায়।’ লোকসানের চিন্তা নিয়ে লবণ মাঠে ঘাম ঝরাচ্ছেন আরেক চাষি জামাল উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘মৌসুমের শুরুতেই যদি লবণের দাম এভাবে কমে যায়, তাহলে লবণ চাষ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে হবে।’
লবণ চাষি সালাহউদ্দীন বলেন, ‘গত বছর রেকর্ড পরিমাণ লবণ উৎপাদন করেছি, কিন্তু লবণের মূল্য কমে যাওয়ায় শত শত লবণ চাষির হাজার হাজার মণ লবণ অবিক্রীত রয়েছে। লোকসান দিয়ে লবণ বিক্রি করতে পারছি না। সরকার সব কিছু সংস্কার করলেও লবণের মূল্য নিশ্চিত করতে পারেনি।’
লবণ আমদানি বন্ধের দাবি :
এদিকে অভিযোগ উঠেছে, সরকারের পক্ষ থেকে লবণের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত না করায় কিছু মিল মালিক স্থানীয় মধ্যস্বত্বভোগীর সঙ্গে সিন্ডিকেট করে লবণের দাম কমিয়ে দিয়েছেন। এতে জেলার হাজার হাজার প্রান্তিক চাষিসহ লবণ উৎপাদন, বিপণন, পরিবহন ও ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত অন্তত ২০ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
চাষিদের আরো অভিযোগ, কস্টিক সোডা উৎপাদনের নাম দিয়ে বন্ড কমিশনারের আওতায় ব্যাক টু ব্যাক এলসির মাধ্যমে বিদেশ থেকে লবণ আমদানি করা হচ্ছে। প্রান্তিক চাষিরা অবিলম্বে লবণ আমদানি বন্ধের দাবি জানিয়ে লবণের ন্যায্য মূল্য প্রাপ্তি নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছেন